এলোমেলো কল্পকথা

রাতে এই শহর কখনো ঘুমায় না, আলো জ্বলতে থাকে, গাড়ি চলতে থাকে, মানুষ আসে যায়, ব্যস্ততার চাদরে মোড়া ! মাঝে মাঝে ঘুম না এলে, আমি আমার ঘরের প্রিয় কোনায় গিয়ে পা গুটিয়ে বসি। দুরের পাহাড় তখন অদ্ভুত সুন্দর লাগে, কৃত্তিম আলোয় সারাদিনের ক্লান্তি মোছার বৃথা চেষ্টায় তাকে আরো অসহায় লাগে, ক্লান্ত লাগে ! আমি অপলক তাকিয়ে দেখি, হুট করে আমাকে কেউ দেখলে হয়ত ভয়ই পাবে, মূর্তির মত মানুষ কিভাবে বসে থাকে !

মেয়েটার সাথে কথা বলতে থাকি, মেয়েটার জন্য মায়া হতে থাকে । মেয়েটার না একটা ছোট্ট সংসারের খুব শখ ছিল, লাল নীল সংসার ! ছোট্টবেলায় তার একটা পুতুল সংসার ছিল, রান্না বাটী, মাথায় গামছা পেঁচিয়ে গিন্নি সাজত, বড় বেলায়ও ওই শখখানা রয়ে গেল ! মেয়েটা হয়ত অনেক কিছু হতে পারত, কিন্তু ওই সংসারের নেশায়, তার আর কিছু হওয়া হল না ! 

জানো,মেয়েটা কত ভাবে কল্পনায় ঘর সাজাত,দুই রুমের একটা ছোট্ট ঘর! মেইন ডোরের সাথেই ড্রয়িংরুম, তার সাথে লাগোয়া একটা বারান্দা। মেয়েটার বনসাই গাছের শখ ছিল, সে ভেবে রেখেছিল ছোট ছোট বনসাই গাছ দিয়ে বারান্দাটা সাজবে । বারান্দাটা হত মেয়েটার এক চিলতে আকাশ, একটা শীতল পাটি, তার উপর নকশী কাথা আর ছোটো ছোটো হাতের কাজ করা কুশন ! বই পড়া, গান শুনা, বৃষ্টি দেখা, শরতের নীল আকাশ কিংবা কুয়াশা ঢাকা শহর সব এক ফ্রেমে বন্দী হয়ে যেত ! ড্রইংরুম হত একদম ছিমছিমে, ছোট ছোট কোমর নাচানো পুতুল কিংবা মেলার মাটির পুতুল দিয়ে ঘরকোনগুলো সাজানো থাকত, আর থাকত বই, হরেক রকম বই! অলস দুপুর কিংবা পড়ন্ত বিকেল,দক্ষিণ হওয়ায় টুং টাং করে স্বপ্নসুরে বেজে উঠত ড্রিমকেচারগুলো। বন্ধের দিনগুলোতে রান্নাঘর থেকে ভেসে আসত হয়ত প্রিয় কোন রান্নার সুবাস ! 

ঘরের দেয়ালগুলো হত সব বক পাখির মত সাদা,কল্পনায় মেয়েটা সেই দেয়ালে হাত বুলিয়ে হেঁটে যায়, ছোট ছোট ছবি ফ্রেম মুচকি হাসতে থাকে, মেয়েটাও হাসে ! শোবার ঘরটা আরো মায়াবী, বড় জানালার ধার ঘেসে রাখা বিছানায় ভোর সকালে মিষ্টি রোঁদের আঁকিবুঁকি, কিংবা কোন অলস দুপুরে প্রিয়মানুষটার বুক ঘেঁষে শুয়ে সংসারের সহজ জটিল হিসাব কথন বা খুব গভীর বোধের স্বপ্নবুনন… খুব কি বেশি চাওয়া ছিল বল ? 

মেয়েটার বয়স হয়েছে, জীবনে যা চেয়েছে, সময় পায়ের কাছে এনে ফেলেছে, তবু কেন ওই না হওয়া ছোট্ট সংসারের জন্য তার এতো হাহাকার লাগে? কেন আজো সেই কল্পজগতের সংসার ভাঙ্গার কষ্টে মেয়েটা রোজ মরে? কেন হাজার চেষ্টা করেও অবিকল সেই সংসার, সেই ঘর মেয়েটা বানাতে পারল না ! মেয়েটা শুধু প্রশ্ন করে, কেন ? আমি বুকের ভেতর মেয়েটাকে জাপটে ধরি, নিজেকে অপরাধী লাগে, উত্তর দিতে পারি না ! রোজ এই প্রশ্নে মেয়েটা ক্ষতবিক্ষত হয় আর আমি মমতা নিয়ে তাকে ধরে রাখি ! হয়ত কোন একদিন তার এই ব্যাথার উপশম হবে, এমন কোন অলীক আশায় !

সংসার ! আহা একটা ছোট্ট সংসার !

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *